মুফতি আসিম নাজিব, অতিথি লেখক::
ছোট ছোট পুণ্যময় এমন অনেক কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, যেগুলো সফলতার পথে আমাদের অনেক দূর এগিয়ে দিতে পারে। আবার এমন অনেক ছোট ছোট পাপের কাজও রয়েছে, যেগুলো আগুনের ফুলকির মতো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাই করে দিতে পারে— আমাদের ইমান-আমলসহ সবকিছু।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে, সে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে, সে তাও দেখবে।’ (সুরা জিলজাল, আয়াত : ৭-৮)
মানুষ ছোট-বড় যে কাজই করুক, তা পাপের হোক আর পুণ্যের, গোপনে হোক কিংবা প্রকাশ্যে, নিজ নিজ আমলনামায় মানুষ কিয়ামতের দিন সবকিছুই দেখতে পাবে। বিশেষত যারা অপরাধী, পাপ ও অন্যায় যাদের বেশি, নিজেদের কৃতকর্মের এমন ধারণাতীত সংরক্ষণ দেখে তাদের মুখে উচ্চারিত হবে হতাশার সুর। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘…এবং আমলনামা উপস্থিত করা হবে। এতে যা লিপিবদ্ধ আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদের দেখবে আতঙ্কগ্রস্ত এবং তারা বলবে- ‘হায়! দুর্ভাগ্য আমাদের! এটা কেমন গ্রন্থ! এ তো ছোট-বড় কোনোকিছুই বাদ দেয় না, বরং তা সবকিছুরই হিসাব রেখেছে। তারা তাদের কৃতকর্ম সামনে উপস্থিত পাবে। তোমার প্রতিপালক কারও প্রতি জুলুম করেন না।’ (সুরা কাহফ, আয়াত : ৪৯)
উত্তম কাজের ইচ্ছে করলেও সওয়াব
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো নেক আমলের ইচ্ছা করল, কিন্তু এখনো তা আমলে পরিণত করেনি; (এ ইচ্ছার কারণে) তার আমলনামায় একটি নেকি লেখা হবে। আর যে ব্যক্তি এ ইচ্ছাকে আমলে পরিণত করল, তার আমলনামায় ১০ থেকে ৭০০ পর্যন্ত নেকি লেখা হবে। আর যদি কোনো গুনাহের ইচ্ছা করে; কিন্তু গুনাহটি না করে তার আমলনামায় কিছুই লেখা হবে না। যদি গুনাহটি করে বসে, তাহলে কেবল তাই (অর্থাৎ একটি গুনাহ) লেখা হবে।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৩০)
অনেক ক্ষুদ্র বিষয় আমাদের জীবন সাজিয়ে রেখেছে। খাবারের স্বাদ স্বাভাবিক রাখার জন্য লবণ দিতে হয়— খুব সামান্যই। সামান্য এ লবণটুকুর অভাবে দামি খাবারের স্বাদ বিস্বাদে পরিণত হতে পারে। একইভাবে নিভু নিভু দুর্বল একটু আগুন থেকেও অসতর্কতাবশত সৃষ্টি হতে পারে বড় অগ্নিকা-, জ্বলে-পুড়ে ছাই হতে পারে ঘর-বাড়ি। সামান্য একটু অসতর্কতায় হারিয়ে যেতে পারে কোটি টাকার সম্পদ। চোখের সামনে নাই হয়ে যেতে পারে বছরের পর বছর ধরে চালানো অবিরাম সাধনার ফল। ছোট বলে তাই কোনোকিছুকেই তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘ভালো কোনো কাজকেই তুচ্ছ মনে করবে না। কাউকে এক টুকরো রশি দিয়ে সহযোগিতা করে হোক, কাউকে একটি জুতার ফিতা দিয়ে হোক, তোমার পানির পাত্র থেকে পানিপ্রত্যাশী কারও পাত্রে সামান্য পানি ঢেলে দিয়ে হোক, মানুষের চলার পথ থেকে কষ্টদায়ক কোনো কিছু সরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে হোক, হাসিমুখে তোমার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে হোক, তোমার ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের পর সালাম দিয়ে হোক, পৃথিবীতে কোথাও কারও একাকিত্ব দূর করে দিয়ে হোক কোনো কিছুকেই তুমি তুচ্ছ মনে করবে না। তোমার কোনো অন্যায়ের কথা জেনে কেউ যদি তোমাকে গালি দেয় আর তুমি জানো তার মধ্যেও এ দোষটি রয়েছে, তখন তুমি তাকে গালি দেবে না; এতে তার প্রতিদান তুমি পেয়ে যাবে, আর তার গুনাহ তার কাঁধেই থাকবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৫৯৫৫)
অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুচ্ছ মনে করা হয় এমন সব পাপ থেকে তোমরা বেঁচে থেকো। তুচ্ছ এসব পাপের দৃষ্টান্ত তো এমন যেমন কিছু মানুষ একটি উপত্যকায় যাত্রাবিরতি করল। তখন তাদের একজন একটি লাকড়ি নিয়ে এলো। আরেকজন আরেকটি লাকড়ি নিয়ে এলো। এভাবে তাদের এ পরিমাণ লাকড়ি সংগ্রহ হয়ে গেল, যা (যেটির আগুন) দিয়ে তারা তাদের রুটি সেকে নিতে পারে। সন্দেহ নেই, এ তুচ্ছ পাপগুলোতে যখন কেউ লিপ্ত হয়, সেগুলো তখন তাকে ধ্বংস করে দেয়। (তাবারানি, হাদিস : ৫৮৭২; মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, হাদিস : ১৭৪৬২; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২২৮০৮)
ছোট ছোট পুণ্য আর তুচ্ছ পাপ নিয়ে এই হলো হাদিসের নির্দেশনা। পবিত্র কোরআনের ভাষ্য আমরা উল্লেখ করেছি মানুষের আমলনামায় ছোট-বড় সব আমলই সংরক্ষিত থাকবে এবং কিয়ামতের দিন সব আমলেরই হিসাব হবে। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয়েরও হিসাব হবে। হাশরের ময়দানের ভয়াবহতার মাত্রা যে কতটা বেশি হবে, তা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। কোরআন ও হাদিস শরিফে এর কিছুটা বর্ণনা রয়েছে। যেমন, সুরা আবাসায় বলা হয়েছে এভাবে, ‘যখন কিয়ামত উপস্থিত হবে, সেদিন মানুষ পালিয়ে যাবে তার ভাই থেকে, তার মা ও বাবা থেকে, তার স্ত্রী ও সন্তানাদি থেকে। সেদিন তাদের প্রত্যেকেরই এমন গুরুতর অবস্থা হবে, যা তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত রাখবে।’ (আয়াত ৩৩-৩৭)
এমন পরিস্থিতিতে সামান্য কয়টি নেকির জন্যেও মানুষ আক্ষেপ করবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের উত্তম আমলে জীবন কাটানোর তাওফিক দান করুন
পাঠকের মতামত